Arthur Rahman
EcoBangla Correspondent
August 4, 2025
499
0
জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে প্রায় সমগ্র বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্বেগজনক সমস্যা। বিশেষ করে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ব্যাপক। এর প্রভাব সরাসরি দেশের কৃষির উপর পড়ছে, যা এমন কৃষিনির্ভর দেশকে মারাত্মক ক্ষতি এবং ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। দেশের কৃষকরা প্রায় প্রতিনিয়ত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ছেন এবং অনিয়মিত মৌসুমের কারণে তাদের কৃষিকাজে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। ১. অনিয়মিত ঋতু পরিবর্তন এবং বন্যা ও খরা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন দেশের ঋতু পরিবর্তন অনিয়মিত হয়ে পরেছে। যেমন, আগে যেখানে সময়মতো বর্ষা আসত, এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই বৃষ্টি দেরি করে আসে। কখনো অপ্রয়োজনীয় সময়ে অতিবৃষ্টি হয়, আবার কখনো প্রয়োজনীয় সময় দীর্ঘদিন খরা বা বৃষ্টিহীন থাকে। এতে করে কৃষি কাজে ব্যাঘাত ঘটে। জমিতে পানি না থাকলে ধান লাগানো যায় না, বেশি পানি হলেও আবার শিকড় পঁচে যায়, ফসল হয় না। এতে করে দেশের কৃষি এবং কৃষকের ক্ষতি। ২. দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল সমুদ্র তীরবর্তী। এসব অঞ্চলে সাগরের পানির জোয়ারে কৃষি জমিতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে, যা জমির উর্বরতা কমায়। বরিশাল, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট সহ দক্ষিণাঞ্চলের আরো কিছু জেলায় এখন অনেক কৃষক ধান বাদ দিয়ে মাছ চাষ শুরু করেছেন। কারণ লবণাক্ত পানি ঢুকে পরায় জমিতে আর ধান হয় না। এটা শুধু ফসলের ক্ষতি নয়, বরং কৃষকের জীবিকার উপর হুমকি। এমন হতে থাকলে হয়ত এসব অঞ্চলে অদূর ভবিষ্যতে কৃষক এবং কৃষি কাজ উভয়ই হ্রাস পাবে। ৩. ঘূর্ণিঝড়, বন্যা সহ জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর আম্পান, ইয়াস বা সিডরের মতো ঘূর্ণিঝড় হানা দেয়। পাশাপাশি অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা হাজার হাজার একর জমির ফসল ধ্বংস করে দেয়। যে সকল কৃষক সারা বছরের জন্য ধান, গম, পাট, আলু, পেঁয়াজ ও অন্যান্য ফসল তোলার প্রত্যাশায় থাকেন, তারা এক মুহূর্তেই সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান। ৪. ফসলের উৎপাদন কমে যায় এ দেশে জলবায়ুর প্রভাব সরাসরি ফসলের উৎপাদন হ্রাস করে দিচ্ছে। ধান, গম, পেঁয়াজ, আলু সহ অন্যান্য ফসল এখন আর পূর্বের মত উৎপাদিত হচ্ছে না। অথচ ফসল উৎপাদনে খরচ বাড়ছে; যেমন, সেচ কাজে, সার এবং কীটনাশকে আগের চেয়ে ব্যয় বাড়ছে প্রতিনিয়তই। ৫. দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে ফসলের উৎপাদন কমে গেলে যে শুধুই কৃষকের ক্ষতি বিষয়টি তা নয়। বরং এটা সমগ্র দেশের জন্য খাদ্য সংকটের ঝুঁকি থাকে এবং খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। জাতিসংঘের এক রিপোর্ট বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন প্রায় ২৫-৩০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে।তাই যদি এটা আমরা এখন থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, মূল্যস্ফীতি, এবং দারিদ্র্যতা বৃদ্ধির জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। বাস্তবতা উপলব্ধিকারী একজন কৃষকের গল্প আব্দুর রহিম পেশায় একজন কৃষক। তিনি নোয়াখালী বসবাস করেন। প্রায় ২০ বছর ধরে ধান চাষ করে আসছেন। তিনি আগে বছরে দুইবার ফসল তুলতেন। এখন বলেন, “জমিতে পানি জমে থাকে, আবার কখনো একফোঁটা পানিও থাকে না। সময়মতো ফসল তুলতে পারি না। ঋণ করে চাষ করি, কিন্তু ফসল না হলে শোধ কি করে দিমু?” আবার অনেক সময় সমুদ্রের লবণাক্ত পানির জোয়ারে ফসলি জমির উর্বরতা কমে যায় এবং ফসল উৎপাদন হ্রাস করে দেয়। যা সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এই দীর্ঘশ্বাস কেবল আব্দুর রহিমের নয়, এটা বাংলাদেশের হাজারো কৃষকের আর্তনাদের প্রতিচ্ছবি। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাব থেকে পরিত্রাণের উপায় ১. জলবায়ু সহনশীল কৃষি জাত সম্প্রসারণ: লবনাক্ততা সহনশীল, খরা সহনশীল এবং বন্যা সহনশীল বিভিন্ন জাতের ধান সহ অন্যান্য ফসলের জাত উদ্ভাবন এবং এসব ফসলের চাষে সরকার ও কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ করতে হবে এবং কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে। ২. প্রশিক্ষণ ও সহায়তা: পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য এ দেশের কৃষকদের যথপোযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রণোদনার মাধ্যমে জলবায়ু অভিযোজন সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ৩. স্মার্ট কৃষি এবং কৃষি প্রযুক্তি আধুনিকায়ন: প্রযুক্তির মাধ্যমে বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস, মাটি ও পানির অবস্থা নির্ণয় করে খরা এবং বন্যা থেকে কৃষিজ ফসলকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা। ডিজিটাল অ্যাপের মাধ্যমে সঠিক সময়ে চাষাবাদের ব্যবস্থা করা এবং এ ব্যাপারে কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং সহায়তা করা। ৪. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা: জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস ও দ্রুত সাড়া দেয়ার ব্যবস্থা জোরদার করার মাধ্যমে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার পাশাপাশি কৃষিজ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও কমিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কেবল পরিবেশগত নয়, এটি অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ দেশের কৃষক সরাসরি এর ভুক্তভোগী। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে সে একা, অবহেলিত। কৃষক শুধু একজন চাষি নয়, আমাদের খাদ্য-সংগ্রামী, আমাদের মাটির মানুষ। এখনি উপযুক্ত সময়, দেশের সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগে একটি স্থিতিশীল ও সহনশীল কৃষি গড়ে তোলা এবং পরিবর্তনশীল জলবায়ুর সঙ্গে অভিযোজন ক্ষমতা বাড়িয়ে দেশের কৃষি এবং কৃষক রক্ষা করার।
Please sign in to leave a comment
No comments yet. Be the first to share your thoughts!
No related articles found.